রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭

প্রজাপতির নির্বন্ধ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রপাঠ-দ্বিতীয় পর্ব

প্রজাপতির নির্বন্ধ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রপাঠ-দ্বিতীয় পর্ব

"সরাচাপা হাঁড়ির মধ্যে মাংস যেমন গুমে গুমে সিদ্ধ হতে থাকে– প্রতিজ্ঞার মধ্যে চাপা থেকে সভ্যগুলিও একেবারে হাড়ের কাছ পর্যন্ত নরম হয়ে উঠেছেন– দিব্যি বিবাহযোগ্য হয়ে এসেছেন– এখন পাতে দিলেই হয়।" -চীরকুমার সভার সভ্য সম্পর্কে অক্ষয় বাবুর সরস মন্তব্য।
...
অক্ষয় বাবুর সাথে একমত আমি। সরাচাঁপা হাড়িতে মাংস সিদ্ধ হয় বৈকি। আবার এখনতো প্রেশার কুকারে মাংস সিদ্ধ হয় তাড়াতাড়িই। খালি সাতটা শিষ দিয়ে বাতাস বের হলেই মুরগী/গরু/খাঁশির মাংস সব সিদ্ধ। হাড় পর্যন্ত নরম হবেই.....

চীরকুমার সভার সভ্যগুলোর অবস্থাও অনেকটা তেমনই। প্রতিজ্ঞাবদ্ধের মধ্যে পিষ্ঠ থেকে একাবারে হাড়ের ক্যালসিয়াম পর্যন্ত নরম হয়ে রয়েছে। এখন যেকোনো ভাবেই হোক, সুন্দরী মেয়ে বা ভালো পাত্রীর সামনে দাড় করালেই গলতে বাধ্য। মোমের কাছে আগুন আনলে যেমন মোম গলবেই তেমনি লোহার কাছে আগুন আনলে লোহা গলতে বাধ্য, হয়ত কিছু সময় নিবে।......

এ থিউরী অক্ষয়ের মাথায় আগেই ছিল। সেজন্যই সে তার দুই বিবাহযোগ্যা শালীর বিবাহ নিয়ে চিন্তিত নন।

রবীন্দ্র উপন্যাসটিতে হাস্যরসের কমতি নেই। প্রহসনমূলক উপন্যাস হওয়ায় প্রতি পৃষ্ঠায় হাসি ও মজার উপকরণ বিদ্যমান, এরমধ্যে শিক্ষনীয় ব্যাপারও রয়েছে । এরূপ হাস্যরসের উদাহরণ উপন্যাস জুড়েই আছে।

উদাহরণ দেখা যাক-
দুই বোনের বিবাহ দেয়া ও চীরকুমার সভার সভ্যদ্বয়কে বশে আনার পরামর্শকরণের নিমিত্ত শৈলবালা যখন রসিকদাকে অন্য ঘরে টেনে নিয়ে যান। দুলাভাইকে গুরুত্ব না দিয়ে রসিকদাকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে মজা করে অক্ষয় শৈলকে বলল, “অ্যাঁ, শৈল! এই বুঝি! আজ রসিকদা হলেন রাজমন্ত্রী। আমাকে ফাঁকি!” শৈল যেতে যেতে পিছন ফিরে হেসে বলল, “তোমার সঙ্গে আমার কি পরামর্শের সম্পর্ক মুখুজ্যেমশায়? পরামর্শ যে বুড়ো না হলে হয় না।”
অক্ষয় বলল, “তবে রাজমন্ত্রী-পদের জন্যে আমার দরবার উঠিয়ে নিলুম।” বলিয়া শূন্য ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে গান ধরলেন----------
এখানে শ্যালীর সাথে দুলাভাইয়ের মজার রসিকতা আছে। আর শিক্ষনীয় বিষয় হলো - পরামর্শ সাধারণত বয়স্ক ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যাক্তির কাছ থেকেই নেয়া শ্রেয়।

ষাটোর্ধ রসিকদার চীরকুমার সভার সভ্য হওয়ার কথা শুনেই হাসতে হাসতে অক্ষয় কইল-
"ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়– প্রতিজ্ঞাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই তার সর্বনাশ।"
ইলিশ যতক্ষণ পানিতে থাকে ততক্ষণই ভালে থাকে ডাঙ্গায় উঁঠানো মাত্রই মারা যায়। তেমনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হলে তেমন কোনো অসুবিধা হয়না। কিন্তু একবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই চারিপাশ থেকে প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গার উপকরণ হাজির হতে থাকে। তখন প্রতিজ্ঞা রাখাই দায় হয় বৈকি। শ্রীশবাবু ও বিপিনবাবু যখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তখনই তাদের পিছনে ঘটক বনমালী, সুকৌশলে ছেলেরূপিনী শৈলবালা, রসিকদা ও অক্ষয় লেগে গেলো প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গানোর নিমিত্ত। শেষটা কি হলো শেষেই বলি বা আপনারা তা জানেন বৈকি....!

অন্যদিকে দেশের দিকে তাকালে এর স্পষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায়। রোজার সময় কারেন্টমন্ত্রি কইল- "রোজার মাসে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে আমরা বদ্ধপরিকর বা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ"। তার প্রতিজ্ঞার পরই লাগাতার লোডশিডিং শুরু, ফলে রোজাদারগণ ক্ষীপ্ত হলেন। প্রকৃতপক্ষে দেশের কারেন্টের যা উৎপাদন তাতে লোডসেডিং হবেই।

আবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বিশেষ কিছুপন্যের দাম রোজার সময় স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা কইলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। আর তারপরই রোজার মাসে দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ কতগুলো পন্যের দাম ১০০ গুন বেড়ে গেল, ফলে আম জনতাতো ক্ষীপ্ত । এমনিতেই বেশি চাহিদা থাকায় ঐপন্যগুলোর দাম কিছুটা বেশিই থাকে, মন্ত্রীর প্রতীজ্ঞায় দুই গুনের জায়গায় ১০০ গুন বাড়ল। সাংবাদিক দেখলেই মন্ত্রীদের অতিকথন ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন বিশিষ্টজনরা। কিন্তু কে শুনে কার কথা।

উপন্যাসে আসি, বাড়ীর অন্যদের অক্ষয় কিংবা শৈলবালার উপর ভরসা হয়না। তারা ভাবে এরা সবকিছুতেই হাস্যরস করে এদের দিয়ে কিছু হবেনা। পুরবালা তো মনে করে মেয়েদের বিবাহ হলেই সব ঝামেলা শেষ।

পুরবালা নিজের স্বামীটি লইয়া সুখী, এবং তার বিশ্বাস যেমন করেই হোক স্ত্রীলোকের একটা বিবাহ হয়ে গেলেই সুখের দশা। তা কি ঠিক?.......

যেকোনভাবে যেকোন পাত্রের সাথে নয়, বিবাহ হতে হবে সুপাত্রের সংগে। সেই সুপাত্রটি অক্ষয় দেখে রেখেছেন, চীরকুমার সভার দুইজন সভ্য শ্রীশ ও বিপিনকেই তার মনে ধরেছে। সে ভাবছে মেয়েগুলোর সামনে সভ্যদ্বয়কে হাজির করাতে পারলেই কেল্লাফতে। সেই মতলবেই তিনি চীরকুমার সভার স্থান তার শ্বশুড় বাড়ীতে করার প্রস্তাব দিয়েছেন সংগে দুইজন নতুন সভ্যও যোগাড় করে দিয়েছেন।

মেয়েদের ক্ষেত্রে অক্ষয়ের ভাবনার সাথে বিশ্বকবির ভাবনা সুন্দর -
"মেয়েদের একটা-না-একটা কিছু উৎপাত থাকা চাই– হয় স্বামী, নয় বিদ্যে, নয় হিস্টিরিয়া।.... লক্ষ্মীর আছেন বিষ্ণু, তাঁর আর বিদ্যের দরকার হয় নি, তিনি স্বামীটিকে এবং পেঁচাটিকে নিয়েই আছেন– আর সরস্বতীর স্বামী নেই, কাজেই তাঁকে বিদ্যে নিয়ে থাকতে হয়!"

অক্ষয়ের বিবাহযোগ্যা দুই শ্যালীই শিক্ষিত এবং সুন্দরীও বটে। একজনের কবিতা/গান লেখার হাত আছে আরেকজনের নকশা করা বা সেলাইয়ের হাত ভালো। দুই বোন নৃপবালা, নীরবালা– ষোড়শী এবং চতুর্দশী। নৃপ শান্ত স্নিগ্ধ, নীরু তাহার বিপরীত, কৌতুকে এবং চাঞ্চল্যে সে সর্বদাই আন্দোলিত।

আর সেই উৎপাত ছড়িয়েই শ্রীশের কাছে পড়ল রুমাল আর বিপিনের কাছে পড়ল গানের ডায়রী। তাতেই দুই সভ্য চীরকুমারের ঘুম হারাম। তার ফলাফলও না হয় পরেই বলব কিংবা পাঠকগণ আগেই জানেন হয়ত.....

চীরকুমার সভা:
চীরকুমার সভার বর্তমান সভাপতি চন্দ্রকুমার। সেই সভার সভ্য শ্রীশ বাবু, বিপিন বাবু, (নির্মলাকে একঝলক দেখার জন্য) পূর্ণ বাবু, (অলিখিতভাবে চন্দ্রবাবুর ভাগ্নী) নির্মলা, এবং (পরিকল্পনার অংশ হিসেবে) রসিকদা ও (ছেলেরূপী) শৈলবালা/অবলাকান্ত।

চীরকুমার সভাস্থল ও সভাপতি:
১০ নম্বর মধুমিস্ত্রির গলিতে একতলার একটি ঘরে চিরকুমার-সভার অধিবেশন হয় (পরবর্তীতে তা অক্ষয়ের শ্বশুড়বাড়ীতে স্থানান্তরিত হয়)। বাড়িটি সভাপতি চন্দ্রমাধববাবুর বাসা। তিনি ব্রাহ্ম কালেজের অধ্যাপক। দেশের কাজে অত্যন্ত উৎসাহী; মাতৃভূমির উন্নতির জন্য ক্রমাগতই নানা মতলব তাঁর মাথায় আসে। শরীরটি কৃশ কিন্তু কঠিন, মাথাটা মস্ত, বড়ো দুইটি চোখ অন্যমনস্ক খেয়ালে পরিপূর্ণ।

চীরকুমার সভার সভ্যগণ:
বিপিন শ্রীশ এবং পূর্ণ তিনজন চীরকুমার সভার সভ্য কলেজের ছাত্র, এখনো সংসারে প্রবেশ করেন নাই।
বিপিন: বিপিন ফুটবল খেলে, তার শরীরে অসামান্য বল, পড়াশুনা কখন করে কেহ বুঝতে পারে না, অথচ চট্‌পট্ পরীক্ষায় পাস করে।

শ্রীশ: শ্রীশ বড়োমানুষের ছেলে, স্বাস্থ্য তেমন ভালো নয়, তাই বাপ-মা পড়াশুনার দিকে তত বেশি উত্তেজনা করেন না– শ্রীশ নিজের খেয়াল লয়ে থাকে। বিপিন এবং শ্রীশের বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য।

পূর্ণঃ পূর্ণ গৌরবর্ণ, একহারা, লঘুগামী, ক্ষিপ্রকারী, দ্রুতভাষী, সকল বিষয়ে গাঢ় মনোযোগ, চেহারা দেখে মনে হয় দৃঢ়সংকল্প কাজের লোক। সভাপতি চন্দ্রমাধব বাবুর ছাত্র হলো পূর্ণ। আর চীরকুমার সভার সভ্য নির্মলাকে মনে মনে পছন্দ করেন তিনি।

চীরকুমার সভার সভ্য ছিল কম। তাই আদর্শিকভাবে তারা হতাশ্বাস ছিল। এ হতাশাকে তারা শক্তি হিসেবে দেখত। সবাই সভ্য হতে পারেনা বলেই তারা গর্ভবোধ করত। তারা একসংগে প্রতীক্ষা নেয়। যেমন- (ক) প্রজাপতি থেকে দূরে থাকা, (খ) জনসেবা করা, (গ) সন্ন্যাসী হয়ে দেশ-বিদেশে পরোপকার করা, দারিদ্র বিমোচন ও আশু বাণিজ্য (দিয়াশলাই তৈরি ও বিক্রি) করে নিজেদের উন্নয়ন ইত্যাদি।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সভা চলাকালীনই সভ্যের ব্রতী ভঙ্গ হওয়ার কারণ ঘটতেই থাকত। যেমন-
"পাশের ঘরে ঈষৎ মুক্ত দরজার অন্তরালে একটি শ্রোত্রী......... একটুখানি বিচলিত হইয়া উঠিল, তাহার অঞ্চলবদ্ধ চাবির গোছায় দুই-একটা চাবি যে একটু ঠুন শব্দ করিল তাহা পূর্ণ ছাড়া আর কেহ লক্ষ্য করিতে পারিল না।"

সেই ঠুন শব্দের মালিক ছিল নির্মলা যার রিনিঝিনি শব্দে পূর্ণবাবু পুলকিত হতেন। নির্মলা সভাপতির ভাগ্নী বলে বাড়িতেই থাকতেন। পরবর্তিতে পূর্ণবাবু নির্মলার জন্যই প্রজাপতির নির্বন্ধে রাজী হলেন, এমনকি সভ্য ছেড়ে দিতেও তিনি পিছপা হননি। যেন সরাচাপা হাড়িতে মাংস সিদ্ধ অবস্থা----

চীরকুমার সভা দুইজন সভ্যের প্রতিজ্ঞা চিরতরে ভেঙ্গে দেবার উদ্দেশ্যে শৈলবালার অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে রসিকদা প্রথমটা হাঁ করে রইলেন, তারপর রাজী হলেন। রসিকদা কইলেন, - “ভগবান হরি নারী-ছদ্মবেশে পুরুষকে ভুলিয়েছিলেন, তুই শৈল যদি পুরুষ-ছদ্মবেশে পুরুষকে ভোলাতে পারিস তা হলে হরিভক্তি উড়িয়ে দিয়ে তোর পুজোতেই শেষ বয়সটা কাটাব।"
রসিকদা শৈলর পুজো করে শেষ বয়সটা কাটিয়েছিলেন কিনা সেটাই প্রশ্ন....

চীরকুমার সভা ভাঙ্গনের আরেক সৈনিক ঘটক বনমালী। তিনি শ্রীশ ও বিপিনকে একসংগে পেয়েই ঝাপটে ধরে প্রস্তাব করেন - "কুমারটুলির নীলমাধব চৌধুরি মশায়ের দুটি পরমাসুন্দরী কন্যা আছে– তাঁদের বিবাহযোগ্য বয়স হয়েছে। কন্যার বাপ যথেষ্ট টাকা দিতে রাজি আছেন।"

চীরকুমার সভার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শ্রীশ ও বিপিন ঘটককে না মারিয়া ভয় দেখিয়ে কইল- "অসবে আমাদের কি?
- এরূপ অবস্থার সৃষ্টি করে ও টাকার লোভ দেখিয়েও কিন্তু শ্রীশ বাবু কিংবা বিপিনকে টলাতে পারলেননা ঘটক বনমালী। আসলে শ্রীশবাবু ও বিপিন বাবু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, চীরকুমার সভার অন্যতম সভ্য তারা। তাদের এই অটল প্রতিজ্ঞার ভীত নাড়িয়ে দেয়া সহজ কাজ নয়। সে কঠিন কাজটি সহজে করে দিয়েছিলেন একমাত্র অক্ষয়, শৈলা ও রসিকদার পরিকল্পনা।

ওদিকে কনের বাড়িতে তখন অন্য কাহিনী-
"“মুখুজ্যেমশায়!” শৈল অক্ষয় বাবুকে ডাকিলেন।
অক্ষয় বলিলেন, “আজ্ঞে করো।”
শৈল কহিল, “কুলীনের ছেলে দুটোকে কোনো ফিকিরে তাড়াতে হবে।”
অক্ষয় উৎসাহপূর্বক কইল তাড়াতেতো হবেই। না তাড়ালে চীরকুমার সভার সভ্যদের কি হবে? তাদের সাথে শ্যালীদের বিবাহ কেমনে দিবো।

শৈলর কথায় মৃত্যুঞ্জয় ও দারুকেশ্বর কুলিন পার্থীকে অক্ষয় একপ্রকার পাগল বানিয়েই বাড়ি ছাড়া করিয়েছেন। অক্ষয়ের বুদ্ধিদীপ্ত রসময় কথার বানে পরাস্ত হয়ে হার মেনেছেন পাত্রদ্বয়। অক্ষয় তাদের মাইর দেয়া বাকি রেখেছিলেন। তবে বিদায় করার আগে তাদের হাতে টাকা গুজে দিতে ভুলেননি। বেচারারা বিলেততো যেতেই পারলোনা মাটন-মুরগী কিংবা হুইস্কিও চেখে দেখতে পারলো না। বিষয়টা নিদারুন কষ্টেরও বটে। দুটো আস্ত জন্তু যেনো।...

পাত্রদ্বয়ের পলায়নের পর রসিকদার নিজ সমালোচনা-
"দুটো আস্ত জন্তু এনেছিলুম বলেই তো রক্ষে ...., যদি মধ্যম রকমের হত তা হলেই তো বিপদ ঘটত। যাকে জন্তু বলে চেনা যায় না সেই জন্তুই ভয়ানক।"
আসলেই রসিকদার এহেন বিশ্লেষণ সঠিক। যে মানুষকে চেনার উপায় থাকেনা সে মানুষ আসলেই ভয়ঙ্কর। সাদামাটা মনের মানুষগুলোই আসল মানুষ, অন্তত তারা ক্ষতির কারণ হবেননা।

প্রজাপতি টার্গেট প্রাক্‌টিস করছিলেন, এ দুটো ফসকে গেল। প্রথম প্রথম এমন গোটাকতক হয়েই থাকে। এই হতভাগ্য ধরা পড়বার পূর্বে অক্ষয় পড়েছিলেন পুরবালার ছিপে। অনেক জলচর ঠোকর দিয়ে গিয়েছিল, বঁড়শি বিঁধল কেবল অক্ষয়ের কপালেই। নৃপবালা ও নিরবালা প্রজাপতির টার্গেটে একদিন ঠিকই তীর বিধঁবেই....
অপেক্ষা সে পর্যন্ত....

চলবে....(আগামী পর্বই শেষ পর্ব)
 
এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় প্রিয় “রবি ঠাকুরের বৈঠকখানায়, ০৫ মার্চ, ২০১৭ তারিখে।
 
 

"প্রজাপতির নির্বন্ধ" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রপাঠ- প্রথম পর্ব

"প্রজাপতির নির্বন্ধ" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রপাঠ-প্রথম পর্ব

“যিনি লজ্জায় পালাতে চাচ্ছিলেন, অথচ পালাতেও লজ্জা বোধ করছিলেন– তাই মুহূর্তকালের মতো হঠাৎ ত্রস্তহরিণীর মতো থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, সামনের দুই-এক গুচ্ছ চুল প্রায় চোখের উপরে এসে পড়েছিল– চাবির-গোছা-বাঁধা চ্যুত অঞ্চলটি বাঁ হাতে তুলে ধরে যখন দ্রুতবেগে চলে গেলেন তখন তাঁর পিঠ-ভরা কালো চুল আমার দৃষ্টিপথের উপর দিয়ে একটি কালো জ্যোতিষ্কের মতো ছুটে নৃত্য করে চলে গেল”-

এ হলো হঠাৎ একপলক দেখা মেয়েটির বর্ণনায় শ্রীশ বাবুর উচ্চারণ। ভালোলাগার শুরুটা আসলে এমন ঝটকা লাগলে ভালোবাসা ঠিকরে বেরিয়ে আসবে বৈকি। কিন্তু উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই শ্রীশ বাবু ভালোবাসা/নারী বিরোধী, সে চীর কুমার সভার অন্যতম সদস্য।

শ্রীশ বাবুর বর্ণনার সাথে রসিক মশাইয়ের কবিত্ব রসবোধ যোগ করলে দাড়ায়-
“এ তো নৃপবালাই বটে! পা দুখানি লজ্জিত, হাত দুখানি কুণ্ঠিত, চোখ দুটি ত্রস্ত, চুলগুলি কুঞ্চিত, দুঃখের বিষয় হৃদয়টি দেখতে পান নি– সে যেন ফুলের ভিতরকার লুকোনো মধুটুকুর মতো মধুর, শিশিরটুকুর মতো করুণ।”

‘ভালোবাসা’ মানে না বারণ, মানে না আইন, মানে না নিয়ম-কানুন। তাহলে মেয়েটির নাম বোঝা গেল নৃপবালা, যাকে এক পলক দেখে উপরের বর্ণনাটা করেছেন চীরকুমার শ্রীশ বাবু। যাঁর কথার সাথে কাজের মিল না থাকলেও সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে শ্রীশ বাবুর হৃদয়ে প্রেমের দোলা লেগেছিল, চীরকুমার সভার চীর সদস্যের এরূপ অনুভুতি থাকতে নেই। কিন্তু ভালোলাগার ক্ষণটি কোথায় কিভাবে এসছে বা আসবে তা হয়ত বিধাতা জানবেন। আর জানবেন রসিক বাবু, অক্ষয় বাবু ও শৈলা, কেননা মজাদার ছকটা তাঁদের গঁড়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “প্রজাপতির নির্বন্ধ” উপন্যাসের পুরোটা আলোচনা করলে সেটা সহজেই অনুমেয় হবে। "প্রজাপতির নির্বন্ধ" একটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। ১৩১১ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী (হিতবাদীর উপহার) সংকলনে চিরকুমার সভা নামে প্রকাশিত হয়। পরে "চিরকুমার সভা" নামে এই উপন্যাসের নাট্যরূপটি ১৩২২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।

অক্ষয় কুমারের শ্বশুর বাড়ী:
শ্বশুড়বাড়ীতে আছেন শ্বাশুড়ী জগত্তারিণী, পুরবালা, পুরবালার স্বামী অজয় কুমার, শৈলবালা (শৈলা/অবলাকান্ত), নৃপবালা, নীরবালা এবং উপন্যাসের সবচেয়ে রসিক সবচেয়ে প্রিয় রসিক বাবু।
 
অক্ষয় কুমার:
কেন যানি মনে হয় অক্ষয় কুমারের সাথে আমার বড়ই মিল। তার বিবাহযোগ্যা তিন শালী, আমারও তাই। সকলের সাথে তিনি হাস্যরস পছন্দ করেন এবং পুরো নব্য প্রকৃতির। মাঝে মাঝে কথার ফাঁকে ফাঁকেই ছন্দ মিলিয়ে কবিতা আবৃতি করেন কিংবা গান ধরেন কিন্তু কয়েক লাইন গেয়েই তা শেষ করেন না। সে বিষয়ে অক্ষয়ের ভাষ্য হলো-
“সখা শেষ করা কি ভালো?
তেল ফুরোবার আগেই আমি নিবিয়ে দেব আলো”

শ্বশুড় পড়লোকগমনের পর শ্বশুর বাড়ীর দায়িত্ব অক্ষয় কুমার পায় অলিখিতভাবে , শ্বাশুড়ী তাঁর ওপর ভরসা করেন। বড় চাকুরী করার পাশাপাশি তিনি শ্বশুড় বাড়ির অভিভাবকের দায়িত্বে ছিলেন, বিশেষ করে বিবাহযোগ্যা শালীত্রয়ের বিবাহ প্রদানের দায়িত্ব। এটা আসলে চিরচেনা সামাজিক পরিবারগুলোর দায়-দায়িত্ব সবসময়ই কারও না কারও ঘাড়ে পরেই। সে দায়িত্ব কেও কেও এড়িয়ে যান আবার কেও সানন্দে গ্রহণ করেন। অক্ষয় বাবু সানন্দেই সকলের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছেন। তার পড়ামর্শেই শ্যালীত্রয় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছে এবং আধুনিক ধ্যান-ধারণায় স্বাধীনভাবে বড় হয়েছে। পাশাপাশি তাঁর সরব প্রভাবে শ্যালীত্রয় পুরো স্বাধীনতাও ভোগ করছে। বউ, শ্যালী তথা সবার সাথেই তার হাস্যরস দেখার মত। মজা করে যুক্তি দিয়ে গান গেয়ে কথা বলতে তিনি পটু। অপরকে বশ করতে তিনি উস্তাদ।

মজার ব্যাপার হলো অক্ষয় কুমার নিজে একসময় চীরকুমার সভার সভাপতি ছিলেন। সে বিষয়ে তার স্ত্রী পুরবালা রঙ্গরস করলে তার সহজ উক্তি-
“সে আর কী বলব! প্রতিজ্ঞা ছিল স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করব না, কিন্তু শেষকালে এমনি হল যে, মনে হত শ্রীকৃষ্ণের ষোলোশো গোপিনী যদি-বা সম্প্রতি দুষ্প্রাপ্য হন অন্তত মহাকালীর চৌষট্টি হাজার যোগিনীর সন্ধান পেলেও একবার পেট ভরে প্রেমালাপটা করে নিই– ঠিক সেই সময়টাতেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আর কি!”

চীরকুমার সভার সভাপতি হিসেবে যেমন তিনি মাতিয়ে রাখতেন সভাকে তেমনি বিয়ের পর শ্বশুড় বাড়ীর সকলকেও তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন তার শ্বশুড়বাড়ীর সর্বদিকের অনুঘটক। যুক্তিতর্ক ও রসবোধ দিয়ে পুরো বাড়ীকেই সুখী করেছিলেন শুধু একটা বিষয়ে কিছুতেই বাড়ীর কয়েকজনকে খুশি করাতে পারছিলেন না, সেটা হলো শ্যালীকাদের বিবাহ প্রদানের জন্য বিবাহ যোগ্য পার্থী খুঁজে আনা। আর সেজন্যই রসিক বাবুর ওপর ভার পড়লো।

রসিক বাবু:
মাথায় টাক, পাকা গোঁফ, গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি রসিক বাবু এ বাড়ীর অন্যতম রসিক সদস্য। সংস্কৃত জ্ঞান সম্পন্ন সৎজন ব্যক্তিত্ব। জগত্তারিণী ভরসা করে রসিক বাবুকে দায়িত্ব দেন - তাঁর অবিবাহিত মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র খোঁজার। যথারীতি তিনি যোগ্য পাত্র হাজির করেন। কিন্তু অক্ষয় বাবুর সুচারু বুদ্ধিতে সেই পাত্রদ্বয় ফেঁসে যান। অক্ষয় বাবুর সুচতুর বুদ্ধিতে পাত্রদ্বয় ক্রিস্টান হতে চাওয়া কিংবা হুইস্কি খেতে চাওয়া কিংবা গৌ/মুরগীর মাংস খেতে রাজী হওয়ায় জগত্তারিণী চরম ক্ষেপে যান এবং পাত্রদ্বয়কে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেন। ফলে, জগত্তারিণী রসিক বাবুকে যারপরনাই বোঁকা ভাবেন এবং মেয়েদের বিবাহ নিয়ে আরও চিন্তিত হয়ে পড়েন। আসলে রিসক বাবু বেশ সরস মানুষ ছিলেন। তিনিই মুলত চীরকুমার সভার দুই সদস্যকে তার রসিক কথাবার্তায় বশ করেছিলেন এবং অক্ষয় বাবুর দুই শ্যালীকার সাথে বিবাহ করানোতে রাজী করিয়েছিলন।
   
মিস্টিভাষীনি শৈলবালা ও পুরবালা যখন প্রজাপতি নৃপবালা/নীরবালার নির্বন্ধে ব্যস্ত তখন চীরকুমার সভার সদস্য দুইজন বাড়িয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে সভাস্থান নিজ শ্বশুড় গৃহে করিয়েছেন অক্ষয় বাবু। প্রিয় পাঠকবৃন্দ কেও কি বলবেন তার উদ্দেশ্য কি ছিল? আর সেটা কি সফল হয়েছিল? উত্তরগুলো পরের পর্বে-
....... চলবে

পূর্বে প্রকাশিত হয়- রবি ঠাকুরের বৈঠকখানা ফেইসবুক গ্রুপে-১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ তারিখে।
https://www.facebook.com/groups/robi.dakur.baitakkhana/permalink/1126357417475627/