রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭

"প্রজাপতির নির্বন্ধ" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রপাঠ- প্রথম পর্ব

"প্রজাপতির নির্বন্ধ" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রপাঠ-প্রথম পর্ব

“যিনি লজ্জায় পালাতে চাচ্ছিলেন, অথচ পালাতেও লজ্জা বোধ করছিলেন– তাই মুহূর্তকালের মতো হঠাৎ ত্রস্তহরিণীর মতো থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, সামনের দুই-এক গুচ্ছ চুল প্রায় চোখের উপরে এসে পড়েছিল– চাবির-গোছা-বাঁধা চ্যুত অঞ্চলটি বাঁ হাতে তুলে ধরে যখন দ্রুতবেগে চলে গেলেন তখন তাঁর পিঠ-ভরা কালো চুল আমার দৃষ্টিপথের উপর দিয়ে একটি কালো জ্যোতিষ্কের মতো ছুটে নৃত্য করে চলে গেল”-

এ হলো হঠাৎ একপলক দেখা মেয়েটির বর্ণনায় শ্রীশ বাবুর উচ্চারণ। ভালোলাগার শুরুটা আসলে এমন ঝটকা লাগলে ভালোবাসা ঠিকরে বেরিয়ে আসবে বৈকি। কিন্তু উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই শ্রীশ বাবু ভালোবাসা/নারী বিরোধী, সে চীর কুমার সভার অন্যতম সদস্য।

শ্রীশ বাবুর বর্ণনার সাথে রসিক মশাইয়ের কবিত্ব রসবোধ যোগ করলে দাড়ায়-
“এ তো নৃপবালাই বটে! পা দুখানি লজ্জিত, হাত দুখানি কুণ্ঠিত, চোখ দুটি ত্রস্ত, চুলগুলি কুঞ্চিত, দুঃখের বিষয় হৃদয়টি দেখতে পান নি– সে যেন ফুলের ভিতরকার লুকোনো মধুটুকুর মতো মধুর, শিশিরটুকুর মতো করুণ।”

‘ভালোবাসা’ মানে না বারণ, মানে না আইন, মানে না নিয়ম-কানুন। তাহলে মেয়েটির নাম বোঝা গেল নৃপবালা, যাকে এক পলক দেখে উপরের বর্ণনাটা করেছেন চীরকুমার শ্রীশ বাবু। যাঁর কথার সাথে কাজের মিল না থাকলেও সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে শ্রীশ বাবুর হৃদয়ে প্রেমের দোলা লেগেছিল, চীরকুমার সভার চীর সদস্যের এরূপ অনুভুতি থাকতে নেই। কিন্তু ভালোলাগার ক্ষণটি কোথায় কিভাবে এসছে বা আসবে তা হয়ত বিধাতা জানবেন। আর জানবেন রসিক বাবু, অক্ষয় বাবু ও শৈলা, কেননা মজাদার ছকটা তাঁদের গঁড়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “প্রজাপতির নির্বন্ধ” উপন্যাসের পুরোটা আলোচনা করলে সেটা সহজেই অনুমেয় হবে। "প্রজাপতির নির্বন্ধ" একটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। ১৩১১ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী (হিতবাদীর উপহার) সংকলনে চিরকুমার সভা নামে প্রকাশিত হয়। পরে "চিরকুমার সভা" নামে এই উপন্যাসের নাট্যরূপটি ১৩২২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।

অক্ষয় কুমারের শ্বশুর বাড়ী:
শ্বশুড়বাড়ীতে আছেন শ্বাশুড়ী জগত্তারিণী, পুরবালা, পুরবালার স্বামী অজয় কুমার, শৈলবালা (শৈলা/অবলাকান্ত), নৃপবালা, নীরবালা এবং উপন্যাসের সবচেয়ে রসিক সবচেয়ে প্রিয় রসিক বাবু।
 
অক্ষয় কুমার:
কেন যানি মনে হয় অক্ষয় কুমারের সাথে আমার বড়ই মিল। তার বিবাহযোগ্যা তিন শালী, আমারও তাই। সকলের সাথে তিনি হাস্যরস পছন্দ করেন এবং পুরো নব্য প্রকৃতির। মাঝে মাঝে কথার ফাঁকে ফাঁকেই ছন্দ মিলিয়ে কবিতা আবৃতি করেন কিংবা গান ধরেন কিন্তু কয়েক লাইন গেয়েই তা শেষ করেন না। সে বিষয়ে অক্ষয়ের ভাষ্য হলো-
“সখা শেষ করা কি ভালো?
তেল ফুরোবার আগেই আমি নিবিয়ে দেব আলো”

শ্বশুড় পড়লোকগমনের পর শ্বশুর বাড়ীর দায়িত্ব অক্ষয় কুমার পায় অলিখিতভাবে , শ্বাশুড়ী তাঁর ওপর ভরসা করেন। বড় চাকুরী করার পাশাপাশি তিনি শ্বশুড় বাড়ির অভিভাবকের দায়িত্বে ছিলেন, বিশেষ করে বিবাহযোগ্যা শালীত্রয়ের বিবাহ প্রদানের দায়িত্ব। এটা আসলে চিরচেনা সামাজিক পরিবারগুলোর দায়-দায়িত্ব সবসময়ই কারও না কারও ঘাড়ে পরেই। সে দায়িত্ব কেও কেও এড়িয়ে যান আবার কেও সানন্দে গ্রহণ করেন। অক্ষয় বাবু সানন্দেই সকলের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছেন। তার পড়ামর্শেই শ্যালীত্রয় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছে এবং আধুনিক ধ্যান-ধারণায় স্বাধীনভাবে বড় হয়েছে। পাশাপাশি তাঁর সরব প্রভাবে শ্যালীত্রয় পুরো স্বাধীনতাও ভোগ করছে। বউ, শ্যালী তথা সবার সাথেই তার হাস্যরস দেখার মত। মজা করে যুক্তি দিয়ে গান গেয়ে কথা বলতে তিনি পটু। অপরকে বশ করতে তিনি উস্তাদ।

মজার ব্যাপার হলো অক্ষয় কুমার নিজে একসময় চীরকুমার সভার সভাপতি ছিলেন। সে বিষয়ে তার স্ত্রী পুরবালা রঙ্গরস করলে তার সহজ উক্তি-
“সে আর কী বলব! প্রতিজ্ঞা ছিল স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করব না, কিন্তু শেষকালে এমনি হল যে, মনে হত শ্রীকৃষ্ণের ষোলোশো গোপিনী যদি-বা সম্প্রতি দুষ্প্রাপ্য হন অন্তত মহাকালীর চৌষট্টি হাজার যোগিনীর সন্ধান পেলেও একবার পেট ভরে প্রেমালাপটা করে নিই– ঠিক সেই সময়টাতেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আর কি!”

চীরকুমার সভার সভাপতি হিসেবে যেমন তিনি মাতিয়ে রাখতেন সভাকে তেমনি বিয়ের পর শ্বশুড় বাড়ীর সকলকেও তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন তার শ্বশুড়বাড়ীর সর্বদিকের অনুঘটক। যুক্তিতর্ক ও রসবোধ দিয়ে পুরো বাড়ীকেই সুখী করেছিলেন শুধু একটা বিষয়ে কিছুতেই বাড়ীর কয়েকজনকে খুশি করাতে পারছিলেন না, সেটা হলো শ্যালীকাদের বিবাহ প্রদানের জন্য বিবাহ যোগ্য পার্থী খুঁজে আনা। আর সেজন্যই রসিক বাবুর ওপর ভার পড়লো।

রসিক বাবু:
মাথায় টাক, পাকা গোঁফ, গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি রসিক বাবু এ বাড়ীর অন্যতম রসিক সদস্য। সংস্কৃত জ্ঞান সম্পন্ন সৎজন ব্যক্তিত্ব। জগত্তারিণী ভরসা করে রসিক বাবুকে দায়িত্ব দেন - তাঁর অবিবাহিত মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র খোঁজার। যথারীতি তিনি যোগ্য পাত্র হাজির করেন। কিন্তু অক্ষয় বাবুর সুচারু বুদ্ধিতে সেই পাত্রদ্বয় ফেঁসে যান। অক্ষয় বাবুর সুচতুর বুদ্ধিতে পাত্রদ্বয় ক্রিস্টান হতে চাওয়া কিংবা হুইস্কি খেতে চাওয়া কিংবা গৌ/মুরগীর মাংস খেতে রাজী হওয়ায় জগত্তারিণী চরম ক্ষেপে যান এবং পাত্রদ্বয়কে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেন। ফলে, জগত্তারিণী রসিক বাবুকে যারপরনাই বোঁকা ভাবেন এবং মেয়েদের বিবাহ নিয়ে আরও চিন্তিত হয়ে পড়েন। আসলে রিসক বাবু বেশ সরস মানুষ ছিলেন। তিনিই মুলত চীরকুমার সভার দুই সদস্যকে তার রসিক কথাবার্তায় বশ করেছিলেন এবং অক্ষয় বাবুর দুই শ্যালীকার সাথে বিবাহ করানোতে রাজী করিয়েছিলন।
   
মিস্টিভাষীনি শৈলবালা ও পুরবালা যখন প্রজাপতি নৃপবালা/নীরবালার নির্বন্ধে ব্যস্ত তখন চীরকুমার সভার সদস্য দুইজন বাড়িয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে সভাস্থান নিজ শ্বশুড় গৃহে করিয়েছেন অক্ষয় বাবু। প্রিয় পাঠকবৃন্দ কেও কি বলবেন তার উদ্দেশ্য কি ছিল? আর সেটা কি সফল হয়েছিল? উত্তরগুলো পরের পর্বে-
....... চলবে

পূর্বে প্রকাশিত হয়- রবি ঠাকুরের বৈঠকখানা ফেইসবুক গ্রুপে-১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ তারিখে।
https://www.facebook.com/groups/robi.dakur.baitakkhana/permalink/1126357417475627/
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন