

"রবিবারে রবির সাথে" পর্ব-২ এবার আমার ভাবনা "রবীন্দ্রনাথের শারদ প্রাতে শরতের মহিমায় বিস্মৃতি জাগানিয়া"। শরতের বর্ণনা করেছি রবীন্দ্রনাথের চেতনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-
"আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।
বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে।
তোমার বুকে বাজল ধ্বনি
বিদায়গাথা, আগমনী, কত যে--
ফাল্গুনে শ্রাবণে, কত প্রভাতে রাতে॥"
বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহড়ের জলাধারের পাশে কাঁশফুল জানান দেয় শরতের কথা, যা প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও। শুভ্র মেঘের রথে চড়ে সকাল-দুপুর আর অলৌকিক সন্ধ্যার পর ভরা-পূর্ণিমায় ঢাকের শব্দ ভেসে আসে দূর গ্রাম থেকে, রবীন্দ্র সসংগীতের সাথে। নির্জন মাঠে নিঃশব্দে বেড়ে ওঠে নিকট ভবিষ্যতের আমন, যেন রবির সুভাগমন। নিশুতি রাত একটু গড়ালে শাপলা-শালুকরা পৃথিবীর মোহমায়ায় দু-একটি পাপড়ির ভাঁজ খোলে, রবির কবিতার ছন্দে। উদাস দুপুরেও খালের টলটলে জল একেবারেই স্থির। যেন শেফালির কোমল পাপড়ির অপেক্ষায় সে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করে। এভাবেই শারদীয় দিন-রাত আসে, আসে শুভ্রতার প্রতীক হয়ে, আসে রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে। শরতের আকাশ কখনো ধোয়া-মোছা এখানে রবীন্দ্রনাথ অনিবার্য। তিনি গানে গানে শরতের আলোছায়ার কথাই বলতে চেয়েছেন-
" শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে,
বনের-পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে"
বর্ষার সেই বিশাল ঢেউয়ের ভয়াবহ নদীটাও শরতে শান্ত হয়ে আসে, কিন্তু বিশ্বকবির কবিতা চলতেই থাকে। শান্ত সেই নদীর দুকূল ছাপিয়ে তখন বানের পরিবর্তে আন্দোলিত কাঁশবন। কাঁশের পেলব পাপড়িগুলো দিনমান হাওয়ায় দোল খায়। অথবা উড়ে উড়ে যায় মেঘগুলোর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ শরদ অনুভব করেছেন অন্য এক মাত্রায়। তিনি লিখেছেন :
‘এক মুহূর্তের জন্য প্রগাঢ় সুখ অনুভব করিলে, সেই মুহূর্তকে যেমন আর মুহূর্ত বলিয়া মনে হয় না— মনে হয় যেন তাহার সহিত অনন্তকালের পরিচয় ছিল, বোধহয় আমারও সেইরূপ এক শরত্কাল রাশীকৃত শরৎ হইয়া উঠিয়াছে। আমি সেই শরতের মর্মের মধ্য দিয়া যেন বহুসহস্র সুদূর পরম্পরা দেখিতে পাই— দীর্ঘ পথের দুই পার্শ্ববর্তী বৃক্ষশ্রেণী যেমন অবিচ্ছিন্ন সংহতভাবে দেখা যায়, সেইরূপে অর্থাৎ সবসুদ্ধ মিলিয়া একটা নিবিড় শারদ আনন্দের ভাবরূপে। আমার মনে হয় স্বভাবতই শরত্কাল স্মৃতির কাল এবং বসন্ত বর্তমান আকাঙ্ক্ষার কাল। বসন্তে নবজীবনের চাঞ্চল্য, শরতে অতীত সুখ-দুঃখময় জীবনের পূর্ণতা। বাল্যকাল না গেলে যেন শরতের অতলস্পর্শ প্রশান্তি অনুভব করা যায় না।’
বর্ষা নানা কারণে আমাদের প্রিয় ঋতু হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে শরৎই অনন্য, রবির লেখনিতেও তা প্রকাশ পায়। এককভাবে প্রতিটি ঋতুকেই আলাদাভাবে উপভোগ করার মতো রূপ রয়েছে। ষড়ঋতুর রূপ হরেক রকম। শরতের দিনগুলোকে স্বপ্নের মতোই মনে হয়। চারপাশে ছড়িয়ে থাকে অনেক স্বপ্ন। বিশ্বকবি সেসব স্বপ্ন কুড়িয়ে নিয়ে কতকিছুইনা ভাবতে বসেন। শরতের আকাশ, শরতের নদী, শরতের ফুল— সবকিছুই কেমন যেন শান্ত মায়াময়, রবি ঠাকুরের লেখায়। শরতের এই শুভ্র রূপ পবিত্রতার প্রতীক। বিলের শাপলা, নদীতীরের কাশফুল, আঙিনার শিউলি— এরা সবাই কোমল, পবিত্র। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। যখন শিশিরের শব্দের মতো টুপটাপ শিউলি ঝরে, তখন অনুভবে শরৎ আসে। কাশবনে দলবেঁধে আসে চড়ুই পাখিরা। নদী শান্ত হয়ে আসে। তখন থাকে না তার দুকূল-ছাপানো বিপুল জলরাশির উত্তাল ঢেউ। আর শরতের নদী মানেই দুই পাড়ে কাশবনের ছোট ছোট রুপালি ঢেউ। বাংলা ছাড়া এমন অনাবিল সৌন্দর্যভূমি আর কোথায় পাওয়া যাবে, তাইতো বিশ্বকবির লেখনি এ বাংলায় এসেই পূর্ণতা পেয়েছে।

শরৎ মানেই শিউলি ফোটার দিন। শিউলির মধুগন্ধ ভেসে বেড়ানোর দিন। শিউলির আরেক নাম শেফালি। রবীন্দ্রনাথ অন্তত দশেক গান ও এক কুড়ির বেশি কবিতায় শিউলির প্রসঙ্গ এনেছেন নানাভাবে নানা মহিমায়। শিউলির ভেতরেই যেন তিনি শরতের সব সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছেন। বিশ্বকবি তার কবিতায় শিউলির বন্ধনায় গেয়েছেন-
‘যখন শিউলি ফুলে কোলখানি ভরি,
দুটি পা ছড়ায়ে দিয়ে আনত বয়ানে।’
‘যখন শরৎ কাঁপে শিউলি ফুলের হরষে।’
‘প্রশান্ত শিউলি ফোটা প্রভাত শিশিরে ছলোছলো।'
"ওই শুনি শূন্যপথে রথ
ও নহে শারদমেঘে লঘু গরজন ।
কাহার আসার আশে নীরবে অবনী
আকুল শিশিরজলে ভাসায় নয়ন!
কার কন্ঠহার হ'তে সোনার ছটায়
চারি দিকে ঝলমল শারদ-কিরণ!
প্রফুল্ল মালতী বনে প্রভাতে লুটায়
কাহার অমল শুভ্র অঞ্চল-বসন!
কাহার মঞ্জুল হাসি, সুগন্ধ নিশ্বাস
নিকুঞ্জে ফুটায়ে তুলে শেফালি কামিনী।
ওকি রাজহংসরব, ওই কলভাষ?
নহে গো, বাজিছে অঙ্গে কঙ্কণ কিঙ্কিনী।
ছাড়িয়া অনন্তধাম সৌন্দর্য-কৈলাস,
আসিছেন এ বঙ্গের আনন্দ-রূপিণী।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন