বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৯

চরুলিয়া থেকে ঢাকা, আমাদের দুখু মিয়া

চরুলিয়া থেকে ঢাকা
আমাদের দুখু মিয়া

অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ।

অনেক সংগ্রাম, আর ত্যাগের বিনিময়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর কষ্টের জীবন, সাহিত্যচর্চা ও নজরুল হয়ে ওঠার গল্প আমাদের বিস্মিত করে।

তিনি ভারতের কোলকাতা
র চরুলিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান নজরুল। এরপর শুরু হয় তাঁর কষ্টের জীবন। ছোটবেলা দুঃখ-কষ্টে কেটেছে বলে সে সময়ে তাঁর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া।

গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে নজরুল যোগ দিয়েছিলেন লেটো গানের দলে। কিছুদিন ছিলেন মক্তবের শিক্ষক। আসানসোলে রুটির দোকানেও কাজ করেছেন তিনি। এরপর সেখান থেকে এক বাঙালি পুলিশ অফিসার তাকে ময়মনসিংহে এনে স্কুলে ভর্তি করেন। স্কুলে পড়ার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেন নজরুল।

যুদ্ধ শেষে কলকাতায় ফিরে এসে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ‘ধূমকেতু’, ‘নবযুগ’ ও ‘লাঙ্গল’ পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন নজরুল।

তিনি আদর্শ শিক্ষক, তিনি বীর সৈনিক, তিনি কর্মঠ নাগরিক, তিনি ছিলেন অকুতোভয়  সাংবাদিক। আবার তিনি ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য গীতিকার,  বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি অনেক খ্যাতির পাশাপাশি তাকে বিদ্রোহী কবির উপাদি দেয়। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লিখে ব্রিটিশ শাসকদের ব্যঙ্গ করেছিলেন তিনি। সেজন্য তাঁকে কারাভোগ করতে হয়েছিল। কারাগারে থাকা অবস্থায় কবি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বাকশক্তি হারান।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট/১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে তাকে কবর দেওয়া হয়।

কিংবদন্তীতুল্য কবির শুরু হয়েছিল চরুলিয়ায় শেষ হলো ঢাকায়। আসলেই কি শেষ হয়েছিলো দুখু মিয়ার কৃত্যি। না, তার কৃত্যি সকলের দু:খ মুছায়। তিনি গণ জাগরণের আরেক নাম।

চরুলিয়ায় তাঁর শুরু হলেও  দুই বাংলায়ই ছিলো তাঁর সমান বিচরণ। কাজী নজরুল আমাদের বাংলা সাহিত্যের এক চেতনার নাম।

দেশ ভাগের সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের বঙ্গবিভাজনে অন্নদা শঙ্কর রায় আশাহত হয়ে লিখেছিলেন-
'‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল,
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে,
ভাগ হয়নি কো নজরুল
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক।
বাঙালি বলতে একজন আছে,
দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।’'

প্রিয় অন্নদাশঙ্কর রায় ঠিকই বুঝে ছিলেন দেশ ভাগ হলেও কবিকে ভাগ করা যাবেনা। তাইতো অসুস্থ নজরুলকে খুব বাজেভাবেই যখন ভাগ  করা হলো- কারো কাছে তিনি হলেন  ‘যবন কবি’, আবার কেউ কেউ বলেন তিনি ‘হিন্দু কবি’। সে অবস্থায় বাধা হয়ে দাড়ালেন আরেক কিংবদন্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সৃষ্টির পাশাপাশি বিদ্রোহী কবিকে আমন্ত্রণ জানালেন দেশে, তাকে করলেন জাতীয় কবি।

কৃত্যিমানের মৃত্যু নেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বরপুত্র নজরুল আমাদের সবার প্রাণে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি আমাদের বিমোহিত করে। তাইতো আজো তাঁকে নিয়ে আলোচনা বিশ্লেষণ চলে সর্বত্রই।

চরুলিয়া থেকে ঢাকা, সর্বত্র বিরাজমান তিনি।
তিনি আমাদের দুখু মিয়া,
তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন